স্ক্যাবিস: ঘা নয়, ছোঁয়াচে চর্মরোগ—সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন
স্ক্যাবিস (Scabies) শুনলে যতটা নিরীহ মনে হয়, বাস্তবে এটি ততটাই কষ্টকর একটি চর্মরোগ। এটি Sarcoptes scabiei hominis নামে একটি অতিক্ষুদ্র পরজীবী মাইটের কারণে হয়ে থাকে, যা ত্বকের ভেতরে গর্ত করে ডিম পাড়ে। ফলে ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ি, প্রদাহ এবং মারাত্মক অস্বস্তি দেখা দেয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এটি খুব সহজেই এক ব্যক্তি থেকে আরেক জনের মাঝে ছড়ায়। বিশেষ করে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বা যাদের মাঝে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শ ঘটে।
স্ক্যাবিস কাদের হয়?
স্ক্যাবিস যে কারও হতে পারে—শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ, এমনকি নবজাতকও এর বাইরে নয়। তবে জনাকীর্ণ, পরিচ্ছন্নতাবিহীন এবং স্যাঁতসেতে পরিবেশে যারা বাস করেন, যেমন—শরণার্থী শিবির, মাদ্রাসা বোডিং, হোস্টেল বা বৃদ্ধাশ্রম, তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ক্যাবিস একাধিকবার প্রাদুর্ভাব আকারে দেখা দিয়েছে।
স্ক্যাবিস ছড়ায় কীভাবে?
স্ক্যাবিস সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে ত্বক-ত্বকের সংস্পর্শে ছড়ায়। তাই:
- একসাথে ঘুমানো বা একই বিছানা ব্যবহার করা
- একই পোশাক, তোয়ালে, বিচানার চাদর ব্যবহার করা
- আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক
এই সবই সংক্রমণের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
স্ক্যাবিসের লক্ষণগুলো কী কী?
স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হলে কিছু স্পষ্ট লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন:
- তীব্র চুলকানি — বিশেষ করে রাতে বেড়ে যায়
- লাল ফুসকুড়ি বা গুটি, অনেক সময় ছোট ফোস্কার মতো দেখায়
- পাতলা, আঁকাবাঁকা দাগ — মাইট যেখানে সুড়ঙ্গ তৈরি করে
- ত্বকে ঘা — অতিরিক্ত চুলকানোর ফলে দ্বিতীয় ইনফেকশন হতে পারে
স্ক্যাবিস সাধারণত শরীরের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় বেশি হয়:
- আঙুলের ফাঁক, কবজি, কনুই, বগল
- কোমর ও নিতম্ব
- যৌনাঙ্গ ও উরুর ভেতরের দিক
- শিশুদের ক্ষেত্রে মুখ, হাত-পা, পিঠেও হতে পারে
স্ক্যাবিস কতটা গুরুতর হতে পারে?
সঠিক চিকিৎসা না হলে স্ক্যাবিস থেকে দ্বিতীয় সংক্রমণ, চুলকানির ফলে গুরুতর ঘুমের ব্যাঘাত, এমনকি স্কিনের স্থায়ী ক্ষত হতে পারে।
স্ক্যাবিসের চিকিৎসা কী?
স্ক্যাবিস নিজে নিজে সারে না—একমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করলেই এটি নির্মূল হয়।
১. ওরাল ওষুধ:
- গুরুতর বা ক্রাস্টেড স্ক্যাবিসে Antihistamine খাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
২. সহ-ব্যক্তিদের চিকিৎসা:
- যেহেতু এটি সংক্রামক, তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সবার চিকিৎসা একসঙ্গে করতে হয়, নইলে বারবার ফিরে আসবে।
স্ক্যাবিস প্রতিরোধে কী করণীয়?
স্ক্যাবিস প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় উপায় হলো—পরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতা:
- আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, চাদর, তোয়ালে গরম পানি দিয়ে ধুতে হবে, রোদে ভালো মত শুকাতে হবে এবং আয়রন করতে হবে বিছানার চাদর সহ।
- ধোয়াযোগ্য নয় এমন জিনিসপত্র ৩ দিন পলিথিনে আটকে রাখলে মাইট মারা যাবে
- ঘর-বিছানা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে
- চিকিৎসা চলাকালীন কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত
- স্যাভলন, হেক্সিজল ব্যবহার বর্জন করতে হবে।
যখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:
- ৭ দিনের বেশি সময় ধরে তীব্র চুলকানি থাকলে
- ছোটদের ক্ষেত্রে ঘুমের ব্যাঘাত বা ক্ষত দেখা দিলে
- পরিবারের একাধিক সদস্য একই লক্ষণ দেখালে
প্রয়োজনে স্কিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন এবং নিজে ও আশেপাশের মানুষকে রক্ষা করুন।
শেষ কথা
স্ক্যাবিস কোনো লজ্জার রোগ নয়, বরং এটি সময়মতো চিকিৎসা করলে পুরোপুরি ভালো হওয়া যায়। নিজের সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমেই স্ক্যাবিসের সংক্রমণ থামানো সম্ভব। আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ উপসর্গে ভুগলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
লেখক:
ডাঃ অনুরূপা সিকদার
এমবিবিএস (ডিইউ), পিজিটি (চর্মরোগ)
সিসিডি (বারডেম), ডিএমইউ
ডার্মাটোসার্জন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল